কৃষিতে সমৃদ্ধ ধামরাই উপজেলায় লতিরাজ কচু চাষে সজাগ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সজাগ ধামরাইয়ের পক্ষ থেকে বিষমুক্ত নতুন নতুন ফসল চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। তার মধ্যে লতিরাজ কচুর চাষ, সজিনা চাষ আনাজীকলার চাষ, বেল আলুর চাষ, বকফুল ও চুকুর চাষ উল্লেখ্যযোগ্য। সজাগভূক্ত কৃষকদের মাঝে সম্ভাবনাময় পরিবেশ বান্ধব। পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল চাষে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিষমুক্ত শাক সবজী চাষে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও ফেরোমনট্র্যাপ ব্যবহার, কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ সজাগের অন্যান্য পদক্ষেপ। নতুন নতুন ফসলের উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ ও সম্প্রসারণে সজাগ কৃষককে সহায়তা প্রদান করছে।
সজাগ কর্তৃপক্ষ বিগত ২০১৩ সনে জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলা থেকে উন্নত মানের লতিরাজ কচুর বীজ এনে পরীক্ষামূলক প্রদর্শনী স্থাপন করে। প্রথম বৎসরই লতিরাজ কচু চাষ ব্যাপক সাড়া জুগিয়েছে এবং ধামরাই অঞ্চলে লতিরাজ কচু চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়। ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বেলে দোয়াশ মাটিতে লতিরাজ কচু চাষের দোয়ার খুলে যায় প্রথম প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমেই। আশাতীতভাবে ফলন হয় প্রদর্শনী প্লটে। লতাগুলো পরিপোষ্ট ও গাছ বড় বড় হয়। স্থানীয় কৃষকবৃন্দ উৎসাহের সাথে পর্যবেক্ষণ করে লতিরাজ কচুর চাষ। লতিরাজ কচুর লতা, পাতা, ডাইগা কান্ড সব কিছুই যাওয়ার উপযোগী এবং চৈত্র বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত লতা হয় লতিরাজ কচুর। লতিরাজ কচুর কান্ড কাঠকচু বিক্রি হয় বাজারে। লতিরাজের চারা হয় লতা থেকেই। আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে যে সমস্ত চারা উৎপন্ন হয় সেগুলো নতুন করে রোপণ করতে হয় পরবর্তী সময়ে লতিরাজ কচু চাষ সম্প্রসারণ জন্য।
পরবর্তী বৎসর ২০১৪ সালে উক্ত চারা শৈলান ধামরাই ও মানিকগঞ্জ জেলার ফাড়িরচর এলাকায় নির্বাচিত কৃষকের মাধ্যমে লতিরাজ কচু চাষ সম্প্রসারণে একাধিক প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালে ফরির চর আদর্শ চাষী মোজাম্মেল এর জমিতে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে লতিরাজ কচু। মোজাম্মেল ১ বিঘা জমিতে ৩৩ হাজার কচুর লতা, ১০ হাজার টাকার কান্ড, পরবর্তীতে ১০ হাজার টাকার চারা সরবরাহ করে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে। মোজাম্মেল এর লতিরাজ কচু চাষে মাঠ দিবস উদযাপন করা হয় এতে লতিরাজের লতা ও গাছ পরিদর্শনকরে উপস্থিত কৃষকবৃন্দ উৎসাহিত হন লতিরাজ কচু চাষে। ধামরাই ইউনিয়নের আশুলিয়া কৃষক সমিতি এবং এর সদস্য শামীম হোসেন প্রদর্শমূলক লতিরাজ চাষ করে স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহিত করেন। লাভজনক লতিরাজ চাষে স্থানীয় কৃষকগণ আগ্রহ প্রকাশ করেন। ধামরাই বাজারে লতিরাজ কচু বেশী দামে বিক্রি হয় এবং স্থানীয় জন সাধারন লতিরাজ কচু খেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। শৈলান প্রদর্শনী স্থাপনে স্থানীয় কৃষকগণ লতিরাজ কচু চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
২০১৫ সালে লতিরাজ কচু সম্প্রসারিত হয় সোমভাগ, ধামরাই ও রোয়াইল ইউনিয়নে বিভিন্ন আগ্রহী চাষীর মাধ্যমে। অত্র উপজেলায় ২০১৫ সালে ৮-১০ বিঘা জমিতে লতিরাজ কচুর চাষ হয়েছে এবং অনেক কৃষক পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেছেন বাড়ীর আশেপাশে চলতি বৎসর প্রত্যেক স্থানেই লতিরাজ কচু চাষ আশাপ্রদ ফলন পাওয়া যাচ্ছে এবং ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে লতিরাজের লতা বিক্রয় শুরু হয়েছে। লতিরাজ কচু চাষ লাভজনক ফসল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ধামরাই অঞ্চলে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে লতিরাজ কচু চাষ থেকে কৃষক ফলন পায়। ফসল সাধারণত বিনষ্ট হয় না। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টিতেও লতিরাজ ফলন দিতে সক্ষম। সামান্য যতœ ও সার ব্যবস্থাপনা করলেই কৃষক আশানুরূপ ফলন পেতে পারে। এ জাতীয় লতিরাজ কচু ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
লতিরাজ কচু চাষে সংক্ষিপ্ত বিবরণীঃ
১। জমিঃ সাধারণত মাঝারী উচুঁ দোঁ-আশ, বেলে দোঁ-আশ মাটির জমির প্রয়োজন।
২। চাষের সময়ঃ লতিরাজ কচু তিনবার চাষ করা যায়। প্রথমবার-ভাদ্র হতে আশ্বিন পর্যন্ত, দ্বিতীয়বার-কার্তিক হতে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত, তৃতীয়বার- মাঘের শেষ হতে ফাল্গুন পর্যন্ত।
* ভাদ্র হতে আশ্বিন পর্যন্ত: ভাদ্র হতে আশ্বিন মাসে চারা রোপণ করলে লতিরাজ ক্ষেত হতে সরাসরি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করা যায়।
* কার্তিক হতে অগ্রহায়ণ: কার্তিক হতে অগ্রহায়ণ মাসে চাষ করলে মূল জমি হতে তোলে পৃথক স্থানে চারা তৈরী করে মূল জমিতে চারা রোপণ করতে হবে।
* মাঘ হতে ফাল্গুন: মাঘ হতে ফাল্গুন মাসে চারা রোপণ করলে পৃথক স্থানে চারা তৈরী করে মূল জমিতে চারা রোপণ করতে হবে।
উল্লেখ্য পৌষ-মাঘ মাসে শীতের প্রকৌপ গাছের বৃদ্ধি থেমে থাকে। জমির অবস্থা ভেদে সুবিধামত সময় চারা রোপণ করা যায়। ফাল্গুন মাস হতে কচুর গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। চৈত্র মাস হতে ভাদ্রমাস পর্যন্ত লতা আসতে থাকবে। ভাদ্র-আশ্বিন মাসের মধ্যেই মূলগাছ (কাঠকচু) বিক্রি করে দিতে হবে। একই ক্ষেত থেকে নতুন চারা সংগ্রহ করা যায়।
৩। সার প্রয়োগঃ জমি ৩-৪ টা চাষ ও মই দিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হবে। জমি চাষের সময় বিঘা প্রতি গোবর ২০০০ কেজি, ইউরিয়া ১০ কেজি, টিএসপি ২০ কেজি, এমওপি ২৫ কেজি দিতে হবে। লতি বেড় হওয়ার পূর্বে বিঘা প্রতি ১০ কেজি ইউরিয়া সারির মাঝে পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে।
৪। চারা রোপণের দূরত্ব : সারি থেকে সারির দূরত্ব ২.৫ ফুট, চারা থেকে চারার দূরত্ব ১.৫ ফুট।
৫। সেচ ও পরিচর্যাঃ লতিরাজ কচুর পানির চাহিদা বেশী তবে শুষ্ক ও ভিজা উভয় অবস্থায় চাষ করা যায়। রোপণের পর ৩-৪ বার পানি সেচ দিতে হবে। গ্রীষ্ম মৌসুমে বৃষ্টি হলে আর সেচের প্রয়োজন হয় না। সামান্য জলাবদ্ধতায় গাছ মারা যাবে না বরং লতা পুষ্টিমান হবে।
৬। পোকাদমনঃ কচুর পাতায় বিছাপোকার আক্রমণ হতে পারে বিছাপোকা পাতার নীচে ডিম পারে। ডিমসহ পাতা সংগ্রহ করে পোকার ডিম, কীড়া মেরে ফেলে পাতা মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। বিছা পোকার আক্রমণ দেখা মাত্র দমন করতে হবে। এছাড়া বিঘাপ্রতি সিমবুশ/রিপকর্ড/ডারসবান প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ঔষধ স্প্রে মেশিনে পানির সাথে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করুন। তবে জীবানকাল বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরাতন পাতা নষ্ট হয়ে যায় আর নতুন পাতা জন্মে। পুরাতন পাতা ও ডাইগা কেটে দিতে হবে। ফলে কীটনাশকের প্রতিক্রিয়া কমে যায়। বিছাপোকার আক্রমণ সব সময় থাকে না।
৭। অর্ন্তবর্তীকালীন ফসল চাষঃ লতিরাজ কচুর চারা রোপণের পর দুই সারির মাঝে অর্ন্তবর্তীকালীন ফসল হিসেবে বোরো বীজতলা, শাকসবজী বীজতলা, লালশাক, পালংশাক, পিয়াজ ও রসুন চাষ করা যায়।
৮। ফসল সংগ্রহঃ লতিরাজ কচুর কান্ড থেকে প্রত্যেক ডাইগার সংযোগ স্থল থেকে লতি বেড় হয়। লতা ১-১.৫ ফুট লম্বা হতে পারে। নিয়মিত লতা সংগ্রহ করলে লতার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত নিয়মিত লতা হতে থাকবে। লতা প্রধান ফসল হলেও পাতা, ডাইগা, কান্ড প্রতিটি অংশই খাওয়ার উপযোগী ও সুস্বাদু। পর্যায়ক্রমে ডাইগা বিক্রি করা যাবে। মাসে ২-৩ বার লতি সংগ্রহ করা যাবে। এতে বিঘা প্রতি মাসে ১০০-১৫০ কেজি লতি সংগ্রহ করা যাবে ভাদ্র মাস পর্যন্ত। তবে প্রতি মাসে বিঘা প্রতি ইউরিয়া ১০ কেজি, পার্শ্ব প্রয়োগ করলে ফলন সব সময় ভাল হয়। বিঘা প্রতি ৪০-৫০ হাজার টাকার লতা, কান্ড ও চারা বিক্রি করা যাবে।
লতিরাজ কচুর ব্যবহার ও বাজার সৃষ্টিঃ
লতিরাজ কচু মুখরোচক সুস্বাদু লৌহ সমৃদ্ধ পুষ্টিকর সবজী। এ কচুর লতা-পাতা ডাইগা কান্ড সবই নানা ভাবে খাওয়া যায়। নিরামিশ, চিংড়ি, শূটকী মাছের সাথে খুবই মুখরোচক খাবার। জয়পুরহাট জেলার লতির কান্ড কেটে কেটে দুধালো গাভীকে খাওয়ায় গাভীর দুধ বৃদ্ধির জন্য। এ ছাড়া কচুর কান্ড শিকড় পাতা জৈবসার প্রস্তুতে ব্যবহার করে থাকে। লতিরাজ কচুর কান্ডের উপরিদিক সাদা কান্ড বিদেশে রপ্তানী হয় এবং লতা অপেক্ষা ১ ফুট পরিমাণ সাদা কান্ড সব চেয়ে বেশী দামে বিক্রয় হয়। জয়পুর হাট জেলা থেকে লতিরাজ কচুর লতা ও কান্ডর সাদা এ অংশ কাগজের প্যাকেট প্যাকিং হয়ে বিদেশে রপ্তানী হয়। বিদেশে রপ্তানী যোগ্য লতা ও কান্ড অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। এমন সম্ভাবনাময় লতিরাজ কচু ধামরাই উপজেলায় চাষ উপযোগী হবে এটা পরীক্ষা করা হয়েছে। সামান্য যতœ ও পরিচর্যা করলেই কৃষকরা স্বল্প ব্যয়ে অধিক মুনাফা লাভ করতে পারবে এবং ঢাকা সহ বিদেশে রপ্তানীযোগ্য ফসল হিসেবে ধামরাই উপজেলায় লতিরাজ কচুর চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।